চায়নার মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থা ও আমি
মঈন উদ্দিন হেলালী তৌহিদঃ বিদেশে পড়লে মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স করতে হয় এতে অনেক সুবিধাদি পাওয়া যায় এতটুকুই ছিলও মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স সম্পর্কে আমার জ্ঞান। যেহেতু সবাইকে করতেই হবে তাই আমিও প্রতি বছর মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স করেছি। কার্ডও পেয়েছি। চায়নায় আসলে এটি কিভাবে কাজ করে আর আদৌও কতটুকু সাপোর্ট পাওয়া যায় এগুলো নিয়ে আমি কিছুই জানতাম না আগে তাই সেসবই লিখবো নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে।
আমি চায়নার সিচুয়ান প্রোভিন্সের সাউথওয়েস্ট পেট্রোলিয়াম ইউনিভার্সিটি তে ২০১৮ সাল থেকে অধ্যয়নরত আছি। চায়নায় আমার জীবন, পড়াশোনার অবস্থা, খাবার-সংস্কৃতি নিয়ে বলতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবে না তাই সেসব বাদ দিয়ে মেডিকেল ইন্স্যুরেন্স নিয়ে কথা এগুনো যাক। ছোটবেলা থেকে ফুলবলের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক আমার। ফুটবল অনেক ভালোবাসি আর নিয়মিত খেলি। সবাই বলে ভালোই খেলি। ভালোবাসা থেকেই ফুটবল খেলি। চায়নায় যাওয়ার পর ইউনিভার্সিটির বিশাল ও নয়নাভিরাম মাঠ আর সাথে চায়নিজসহ বিদেশীসব অসাধারণ ফুটবল পাগল ফ্রেন্ড আমাকে আর কে আটকায়। ডিপার্টমেন্টের মুল টিম থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির মুল টিম সবখানেই নিজের নাম রেখেছি।
ফিজিক্যাল এডুকেশন কোর্সে ফুটবল নিয়েছিলাম লাওশি( চায়নিজ ভাষায় টিচারকে লাওশি বলে) তো আমাকে ১০০ই দিয়েছেন। সাথে ছোট খাটো ইউনিভার্সিটির বাইরের কর্পোরেট লীগসহ খেলাসহ দিনগুলো আমার ভালোই কাটছিলো। তবে সে ভালো দিনগুলি বেশিদিন স্থায়ী হয় নি।
গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর। একটা টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে বল কন্ট্রোল করার সময় হঠাৎ করে আমার পা ঘুরে গিয়ে আমি মাটিতে পড়ে যাই। খেলার মধ্যে এমন অনেকবার হয়েছে। তাই ভাবলাম উঠে দাঁড়াতে পারবো।কিন্তু না। আর পারছি না। পা প্রচন্ড ব্যাথা। ফুলে গিয়ে খুব বাজে অবস্থা। ব্যাথায় কাতরাচ্ছি আর সবাই মিলে আমাকে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেলো হসপিটালে। ডাক্তার আমকে এক্সরে , এম আর আই এবং সিটি স্ক্যান সব করার পর বললেন, আপনার হাঁটুর লিগামেন্ট ছিড়েঁ গেছে। আপনাকে পরবর্তীতে আবার খেলতে চাইলে অপারেশন করতে হবে। একথা শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাও সাহস করে বলেছি আমি খেলা ছাড়া থাকতে পারবো না তাই অপারেশন করাবো।
কিন্তু কিছুদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল তাই একমাস করাতে পারবো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন আমার সুবিধা মতো সময়েই করাবেন । একটু আশ্বস্ত হলাম। এরপরে জিজ্ঞেস করলাম কত খরচ পড়বে। তিনি বলেন ৪৫ হাজার আর এম বি । বাংলা টাকায় প্রায় ছয় লাখ টাকার কাছাকাছি । একথা শোনার পর মনে হলো ফুটবল খেলা আর আমার ভাগ্যে নেই। খুব বিষণ্ণ মনে ডর্মে ফিরলাম। আশপাশের সবাইও খুব চিন্তিত।
ডর্মে ফিরে দেখি ডিপার্টমেন্ট এর কাউন্সিলর আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাকে খুবই আদর করেন আর সব ফরেইনার স্টুডেন্টদের তিনি খুব কেয়ার করেন। তিনি বললো তুমি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাথে কথা বলো। কথাটা মাথায় ঢুকলো। তবে শিউর ছিলাম না কতটা কাজে দিবে। তাই পরদিন চলে গেলাম ওআইএ (Office of International Affairs) তে। সব শুনে কর্মকর্তা বললো, "তুমি ইন্স্যুরন্সে ফুল সাপোর্ট পাবে। আমরা সবাই তোমাকে সাহায্য করবো"। আমাকে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করতে বললো।
কথামতো ফোন দিলাম । খুব সুন্দর গলার ফোনের ওপার থেকে ভদ্রমহিলা আমার পাসপোর্ট নাম্বার জানতে চাইলেন। তারপরেই আমার পুরো কথা শুনলেন তারপর বললেন, "সাধারনত আমাদের নিয়ম হলো আপনি চিকিৎসা চালিয়ে যাবেন। সকল মানিরিসিপ্ট সংগ্রহ করবেন । চিকিৎসা শেষে আপনি সকল কিছু আমাদের পাঠিয়ে দিবেন । তারপর আমরা আপনার একাউন্ট এ ব্যয়কৃত অর্থ পাঠিয়ে দিবো"। আমি কিছু বলার আগেই তিনি আবার বললেন, " দেখুন আপনার তো অনেক টাকার প্রয়োজন আমি আপনাকে এডভান্স পেমেন্ট করার কোনো ঊপায় আছে কি না জেনে জানাচ্ছি।" একথা শোনার পর মনে একটু সাহস আসলো। ঠিক পাঁচ মিনিট পর ফোন এলো এবার ভদ্রলোক। তারভাষ্যমতে তারাঁ আমাকে এডভান্স দিবেন চিকিৎসা বাবদ যা লাগবে। তবে তাঁরা আমার ইউনিভার্সটি ও ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চায়। আমিও রাজি হয়ে গেলাম । তারপর আমাকে আর কোনো কিছুতে বেগ পেতে হয় নি। ইউনিভার্সিটির কাউন্সিলর ও ওআইএ এর সেই কর্মকর্তা সকল পেপারওয়ার্ক সেরে ফেললেন। ডাক্তারও তার শত ব্যস্ততার মাঝে আমার ব্যাপারটাকে অত্যন্ত গুরত্বের সব ফর্মালিটি শেষ করেছেন ।
এই বছরের জানুয়ারীর ১৫ তারিখ আমার অপারেশন হলো। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমার অপারেশন সাকসেসফুল হলো। সকল খরচ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বহন করলো আমাকে সেদিকে কোনো টেনশনই করতে হয় নি। হাসপাতালের একমাত্র ফরেইনার রোগী হওয়াই নার্স থেকে শুরু সকল ডাক্তারের যত্নের কমতি ছিলো না। সাথে বন্ধু-বান্ধুবী আর ইউনিভার্সটির সকলের অক্লান্ত সাপোর্ট তো ছিলোই বিদেশের মাটিতে নিজ পরিবারের শূন্যতা ছিলোই না। অপারেশন শেষ হওয়ার দু একদিনের মধ্যেই কোভিড-১৯ এর খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
আমিও ভার্সিটির সবার উপদেশানুযায়ী দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। যেদিন হসপিটাল থেকে বিদায় নিয়েছিলাম ডাক্তার থেকে নার্সসহ সবাই আমকে যেভাবে বিদায় দিয়েছিলো তা কখনোই ভুলবো না। রিসিপশনে দেখি আমাকে কাগজ পত্রের পাশাপাশি ৫ হাজার ১ শত ৫৪ আর এম বি ফেরত দিয়ে বলেছ এই টাকা আপনার খরচ হওয়ার কথা ছিলো তবে আমাদের সেটা লাগে নি। এভাবে এতগুলো টাকা ফেরত হাসপাতাল থেকে পাবো তা তো আকাশকুসুম কল্পনা আমাদের( বাংলাদেশীদের) জন্যে। সত্যিই চায়নিদের জন্যে শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো সেদিন থেকে। আমিও সেই অর্থ হাতে পেয়ে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে তাদের পাঠিয়ে দিলাম আর পরদিন দেশে ফিরলাম।
জীবনে আমাদের অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি তবে এই অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা গুলোর একটি। আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি । পড়াশোনাসহ, রাজনৈতিক বা আরো অনেক বিষয়ে চায়না সম্পর্কে মানুষের ধারনা মিশ্র। তবে ব্যাক্তি আমার কাছে চায়না ও চায়নার মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার । এখন দেশে আছি এবং অনলাইনে ক্লাস করছি আর মুখিয়ে আছি চায়না ফেরার এবং ফুটবল নিয়ে ছুটে চলার । বুক বাঁধছি আরো কিছু অসাধারণ অভিজ্ঞতার জন্যে!
মঈন উদ্দিন হেলালী তৌহিদ
সাউথওয়েস্ট পেট্রোলিয়াম ইউনিভার্সিটি
চেংডু, সিচুয়ান, চায়না।
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।