
নীল ছোঁবল

শিরিন আক্তারঃ ঊনিশের প্রথম দিকে, মার্চে, চীন হতে হঠাৎ করেই পড়তে যাওয়ার জন্য স্কলারশিপ পেলাম। যাবো কি যাবো না—পড়লাম বেশ দোটানায়। কারণ, বাংলাদেশী হিসেবে আর দশজনের মতো আমার মাথাতেও বিসিএস ছাড়া ছোটবেলা থেকে আর কিছুই ছিল না। চলার আরও অনেক অপশন থাকতে পারে তা আমি খুব একটা ভাবতেই পারিনি। যাহোক, শেষমেশ চলে আসলাম মহাপ্রাচীরের দেশে। বেইজিংয়ে তখনও বেশ ঠান্ডা। সজপেশ জ্যাকেট না পরলে যেখানে হাড় কাঁপানো কনকনে ঠান্ডায় বাইরে বেরোনো বেশ মুশকিল ঠেকে, সেই বেইজিংয়ে। শুনেছি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে নাকি রীতিমত বরফ পড়ে। বেইজিংয়ের সব—মহাপ্রাচীর, সামার প্যালেস, বড়ো বড়ো পার্ক দেখা শেষ। কিন্তু সাধের দুধরঙা তুষারের সঙ্গে মোলাকাত আর হলো না। কারণ, তুষার আমার দর্শনে আসার পূর্বেই আমি অন্য শহরে চলে গেলাম।
বর্তমানে আমি একবারে দক্ষিণ চীনের হাংজু শহরে থাকি। দেশে এত চায়ের বাগান—বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুর না হলে, দক্ষিণবঙ্গের মেয়ে হওয়ায় তা চোখের দেখায় দেখার সুযোগ আর হতো না। ছবির ক্যানভাসেই ‘একটি কুঁড়ি, দুটি পাতা’ আটকে থাকত, চিরদিন। কী সৌভাগ্য আমার! গবেষণার বিষয় হিসেবে পেলাম চা। তা-ও আবার গ্রিন টি! আমরা বাঙালী মানুষ লাল চা তে অভ্যস্ত। সাথে এক কাপে তিন চামচ চিনি। বলা যায় শরবতের চা ভার্সন! এখন সেই আমাকে-ই গবেষণা করতে হবে গ্রিন টি নিয়ে। যদিও দেশে থাকাকালীন গ্রিন টি’র সবুজকে আমি কখনোই ভালবাসতে পারিনি। কে তা হয়ে ওঠেনি, সে ভিন্ন আলাপ...
চীনে এসে আমি প্রথমে কিছুদিন বেইজিংয়ে অবস্থানের পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি একরকম বদলি হয়ে হ্যাংজু চলে আসলাম। বেইজিং আর হ্যাংজু—যেন অহি নকুল! একেবারে বিপরীত মেরুর দুই দেশ! বেইজিংয়ে যেমন হাড়কাঁপানো কনকনে ঠান্ডা; হ্যাংজুতে গরমটা একটু বেশি। একটা চীনের উত্তরে, তো অন্যটা দক্ষিণে। জাঁকালো, রমরমা, অত্যাধুনিক বেইজিং ছেড়ে হঠাৎ করে আমি যেন ধপ করে পড়লাম জনমানবশূন্য পাহাড়ি জঙ্গলে ঘেরা চায়ের বাগানে। মানুষ বলতে চাইনিজ ছাড়া আর চোখে পড়ার মত কেউ ছিল না। আমি কী আর মানুষ ছিলাম তখন? ভাষা না জানা থাকলে নিজেকে অবলা জীব জানোয়ারের মতই লাগে আর কী!
আসার বেশ কয়েক দিন পরেই শুনলাম সাপের কামড়ে একজন কর্মচারী হাসপাতালে। ভীষণ অসুস্থ। অফিসিয়াল গ্রুপ গুলো তে হুসিয়ারী করা হলো খোলা জুতা পরে যেন চলা না হয়। আমি পড়লাম ভারী মুশকিল এ। এই সাহেবী বুট জুতা পরে আমাকে রাতেও চলা লাগবে বলে। বলতে না বলতে অফিসের সামনে তার সাথে আমার ও একদিন দেখা হয়ে গেলো রাতের বেলা। এত ভয়ংকর সুন্দর দেখতে,সবুজ রং এর চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে। যদিও তার সেই অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্যের থেকে ঐ পালিয়ে বাঁচা টা অনেক জরুরী ছিলো। পরে আমার চেঁচামেচি দেখে গেটম্যান এসে তাকে উদ্ধার করে ছবি দিয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে রানীর মত ফনা তুলে সে রাস্তা পার হচ্ছিলো। যাগগে একটা জিনিস ভালোই হলো তারপর থেকে সেই সাহেবী জুতা না পরলেও নরমাল সু গুলো পরতে আর ভুল হয় না।
হঠাৎ একদিন ফিল্ড থেকে আমার কিছু গবেষণার কাজ করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো,মোবাইল এর লাইট জ্বালিয়ে কান্ত আনমনে গাইতে গাইতে ফিরছিলাম "জিয়া বে কারার হে, এ্যাছে বাহার হে"। হঠাৎ মোবাইলের আবছা আলোয় সামনে দেখি একজন ফনা তুলে রাস্তা পার হচ্ছে যেন সে রাতের ডিনার করে বেশ নিশ্চিতে ফিরছে। তাই আমার উপর তার বেশি আগ্রহ ছিলো না। আমি পৃথিবীতে যে জিনিস টা বেশি ভয় পাই, সেই জিনিস টা আমার সামনে এসে পড়েছে। আমি ভয়ে উল্টো দিকে প্রানপনে ছুট মারলাম। সামনে কয়েক টা বয়স্ক চাইনিজ এর সাথে দেখা হলো,শুধু বলেছিলাম ঐ, ঐ...বাকিটা তারা বুজে গেছিলো আমার ভাবমূর্তি দেখে। তারা সামনে এগিয়ে দেখলো তখনও সে রাস্তা পার হচ্ছে আনমনে, তাকে লেজ ধরে ঐ দুর পাহাড়ে ছুড়ে মারলো। আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। চাইনিজ রা সাপ কে বেশি মারে না, তারা তাকে উদ্ধার করে জন মানব শুন্য ঘন পাহাড়ি জংগলে ছেড়ে দেয়। সাপের বিষ ভালো ঔষধী গুন আছে, অনেকে তো এগুলো ধরে ধরে খায়। একবার এক ল্যাবমেটের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন এটা ধরে ছেড়ে দেয়,সে বলে একজন কে মারলে অনেক এসে পরবর্তী তে কোন ক্ষতি করে দিতে পারে। হাসি পেয়েছিলো আমার, আশ্চর্য ও হয়েছিলাম কিছুটা। তবে সেই রাতে বুজেছিলাম এই খানে থাকতে হলে, তাদের সাথে আমার আবার দেখা হবে। তাই সেদিন থেকে মনে মনে সতর্ক হয়ে গেলাম। আমার রুম টা পাহাড়ের পাদদেশে, নিচতলায়। মাঝে মাঝে গভীর রাতে জানালার ওপাশে নড়াচড়ার শব্দ শুনেও বাইরে বের হই না। হয়ত সে গরমে এসির হওয়া খেতে এসেছে। এই ঘন জংগলে যেমন ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে, সাথে সাথে একাকীত্বের পরিমান টাও বোঝা যায়। আজ কাল কাজের চাপে অফিসেই বেশি থাকা হয়, তারপরও একাকীত্ব টা থেকেই যায়। হঠাৎ করে কেউ এই পাহাড়ি অনাবিল সৌন্দর্য ঘেরা সবুজ চা বাগানের দৃশ্য টা দেখলে যেমন মন ভরে যাবে, তেমনি চলার পথে রানীর বেশে তাদের সাথে দেখা হয়ে যেতেও পারে ভয়ংকর ভাবে।
বছরের পর বছর এখানে থাকার পর এখন আর তাদের নীল ছোঁবলের আর ভয় পায় না। একটা অভ্যস্ততা, একটা কেমন অজানা মায়া জন্মে গিয়েছে এই সবুজ টীলা, সকালে এক কাপ গ্রীন টি, এত এত সব ভালো মানুষ গুলোর প্রতি! এদের কে না হলে আমার এখন আর ভালো লাগে না। প্রথম প্রথম ঘন ঘাসে ঘেরা সবুজ জংগল, আর অসম্ভব একাকীত্বে ঘিরে থাকা ভয়ংকর পাহাড়ী সৌন্দর্য দেখে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু এখন এদের সাথে একটা ভালো ভাব হয়ে গেছে। প্রকৃতি এমনই, সবাই কে দিন শেষে আপন করে নেয়, শুধু তাকে বুঝতে একটু সময় লাগে।
আজও তাদের সাথে আমার দেখা হয়, মাঝে মাঝে অফিসিয়াল নোটিশ দেখি, আবার কারও সামনে পড়েছে হয়ত কাউকে কামড়েও দিয়েছে কিন্তু আর ভয় লাগে না, মুচকি হাসি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। এভাবে তাদের সাথে আমার দিনকাল ভালোই যাচ্ছে, কাজের চাপ ও বেড়ে গেছে। তাদের নিয়ে আর ভাববার সময় পাই না।
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।