
চীনা নববর্ষ: ইতিহাস, সংস্কৃতি, রীতি ও উদযাপন

চাইনিজ নিউ ইয়ার বা চীনা নববর্ষ চীনা সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। এটি চন্দ্র ক্যালেন্ডারের উপর ভিত্তি করে পালিত হয় এবং সাধারণত জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে উদযাপিত হয়ে থাকে। ২০২৫ সালের চীনা নববর্ষ ২৮ জানুয়ারি পালিত হয়েছে, যা সাপের বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
এই উৎসবটি শুধুমাত্র
চীনেই নয়, বিশ্বজুড়ে চীনা সম্প্রদায়ের জন্যও একটি বড় উদযাপনের সময়। এই নিবন্ধে
আমরা চীনা নববর্ষের ইতিহাস, রীতি, খাবার, সংস্কৃতি, উদযাপন এবং চীনের বিভিন্ন
অঞ্চলে এর বৈচিত্র্যময় পালনের ধরন নিয়ে আলোচনা করব। এছাড়াও, বিদায়ী বছরের শেষ
দিন এবং বসন্ত উৎসবের সাথে নববর্ষের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা থাকবে।
ইতিহাস: প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক যুগ
পর্যন্ত
চীনা নববর্ষের ইতিহাস প্রায় ৩,৫০০ বছরের পুরনো। এটি শাং রাজবংশ (১৬০০-১০৪৬ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে পালিত হয়ে আসছে। প্রাচীনকালে, এই উৎসবটি কৃষি চক্র ও ঋতু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত ছিল। চীনা ক্যালেন্ডার অনুসারে, নববর্ষের দিনটি শীতের সমাপ্তি এবং বসন্তের সূচনাকে চিহ্নিত করে, যা নতুন ফসলের মৌসুমের সূচনা করে।
একটি প্রাচীন শ্লোক
অনুসারে, "নিয়ান" (年) নামের একটি দানব গ্রামবাসীদের আতঙ্কিত
করত। লোকেরা আবিষ্কার করেছিল যে নিয়ান লাল রং, উজ্জ্বল আলো ও জোরে শব্দে ভয়
পায়। তাই, আজও লাল রঙের পোশাক, আতশবাজি ও লাল লণ্ঠন ব্যবহার করা হয়।
মিং (১৩৬৮-১৬৪৪) ও ছিং
(১৬৪৪-১৯১২) রাজবংশের সময়, চীনা নববর্ষের উদযাপন আরও বর্ণাঢ্য এবং আনুষ্ঠানিক
হয়ে ওঠে। সম্রাটরা এই সময়ে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন, আর সাধারণ মানুষ
পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাত এবং ঐতিহ্যবাহী খাবার তৈরি করত।
চীনা রাশিচক্র: প্রাণী ও বছরের সম্পর্ক
চীনা রাশিচক্র ১২টি প্রাণীর চক্রের উপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে প্রতিটি বছর একটি নির্দিষ্ট প্রাণীর সাথে যুক্ত। এই প্রাণীগুলো হলো:
১. ইঁদুর (Rat): বুদ্ধিমত্তা ও সম্পদের প্রতীক।
2. বলদ (Ox): পরিশ্রম ও স্থিতিশীলতার
প্রতীক।
3. বাঘ (Tiger): সাহস ও শক্তির প্রতীক।
4. খরগোশ (Rabbit): শান্তি ও সৌভাগ্যের
প্রতীক।
5. ড্রাগন (Dragon): শক্তি ও সৌভাগ্যের
প্রতীক।
6. সাপ (Snake): রহস্য ও বুদ্ধিমত্তার
প্রতীক।
7. ঘোড়া (Horse): স্বাধীনতা ও শক্তির
প্রতীক।
8. ছাগল (Goat): শান্তি ও সৃজনশীলতার
প্রতীক।
9. বানর (Monkey): চালাকি ও আনন্দের
প্রতীক।
10. মোরগ (Rooster): আত্মবিশ্বাস ও সততার
প্রতীক।
11. কুকুর (Dog): বিশ্বস্ততা ও সততার
প্রতীক।
12. শূকর (Pig): সম্পদ ও সৌভাগ্যের প্রতীক।
২০২৫ সাল সাপের বছর হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। সাপের বছরটি বুদ্ধিমত্তা, রহস্য এবং সৌভাগ্যের প্রতীক। এই বছরটি নতুন সুযোগ ও সাফল্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
বিদায়ী বছরের শেষ দিন: চুশি (除夕)
চীনা নববর্ষের আগের
দিনটি "চুশি" (除夕) নামে পরিচিত, যা বিদায়ী বছরের শেষ দিন
হিসাবে পালিত হয়।
এই দিনের প্রধান রীতিগুলো হলো:
- বাড়ি পরিষ্কার করা – পুরানো বছরের দুর্ভাগ্য দূর করতে ঘর পরিষ্কার করা হয়।
- ডিনার: পরিবারের সবাই একসাথে বসে বিশেষ ডিনার উপভোগ করে, যেখানে ডাম্পলিং, মাছ ও নিয়ান গাও পরিবেশন করা হয়।
- আতশবাজি: মধ্যরাতে আতশবাজি ফাটানো হয়, যাতে পুরানো বছরের দুর্ভাগ্য দূর হয় এবং নতুন বছরের শুভ সূচনা হয়।
- লাল খাম ("হংবাও" 红包): পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা তরুণদের লাল খাম উপহার দেন, যা সৌভাগ্য ও সম্পদের প্রতীক।
বসন্ত উৎসব: চুনজি (春节)
চীনা নববর্ষের ১৫ দিনের
উৎসব "বসন্ত উৎসব" বা "চুনজি" (春节) নামে পরিচিত।
এর প্রধান আকর্ষণসমূহ
হলো:
- পরিবারের
পুনর্মিলন – সবাই একত্রিত হয় ও আনন্দ ভাগ করে।
- ড্রাগন
ও সিংহ নাচ – সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির জন্য এই ঐতিহ্যবাহী নাচ পরিবেশিত হয়।
- লণ্ঠন উৎসব: নববর্ষের ১৫তম দিনে লণ্ঠন উৎসবের মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ উদযাপন
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে
নববর্ষ উদযাপনের ধরন কিছুটা ভিন্ন হতে পারে:
- উত্তর
চীন – ডাম্পলিং (জিয়াওজি) খাওয়ার প্রচলন বেশি; আতশবাজি ও লাল লণ্ঠন
ব্যবহারের প্রচলনও বেশি।
- দক্ষিণ
চীন – নিয়ান গাও (চালের কেক) ও মাছের খাবার বেশি জনপ্রিয়।
- শাংহাই
– বড় প্যারেড, আলোকসজ্জা ও স্প্রিং রোলস খাওয়ার চল রয়েছে।
- তিব্বত – তিব্বতি নববর্ষ (লোসার) পালিত হয়, যেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশি প্রচলিত।
রীতি ও সংস্কৃতি
চীনা নববর্ষের কিছু
গুরুত্বপূর্ণ রীতি হলো:
- পরিবারের
পুনর্মিলন
- লাল
খাম ("হংবাও") প্রদান
- আতশবাজি
ফোটানো ও লাল লণ্ঠন জ্বালানো
- বাড়ি
পরিষ্কার করা
- ড্রাগন ও সিংহ নাচ
খাবার
নববর্ষে পরিবেশিত বিশেষ খাবারের মধ্যে কিছু জনপ্রিয় হলো:
- ডাম্পলিং
(জিয়াওজি) – সম্পদ ও সৌভাগ্যের প্রতীক।
- নিয়ান
গাও (চালের কেক) – উচ্চতা ও সাফল্যের প্রতীক।
- মাছ
– সমৃদ্ধি ও অতিরিক্ত সম্পদের প্রতীক।
- স্প্রিং
রোলস – সৌভাগ্য ও নতুন শুরুর প্রতীক।
- লম্বান নুডলস – দীর্ঘ জীবনের প্রতীক।
চীনা নববর্ষ শুধুমাত্র
একটি উৎসব নয়, বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চলে
আসছে। ২০২৫ সালের সাপের বছর সকলের জন্য সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য বয়ে আনুক!
Arif/Raoha
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।