চীনা শিক্ষক দিবস: শিক্ষার প্রদীপ ও সংস্কৃতির অমূল্য ঐতিহ্য
"শিক্ষক হলেন জ্ঞানের দূত, সংস্কৃতির সংগীতজ্ঞ, এবং মানবতার স্তম্ভ। তাঁদের অবিশ্রাম প্রচেষ্টা ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে গঠিত হয় এক জাতির ভবিষ্যৎ।"
এই অমর উক্তিতে প্রকাশ পায় চীনা শিক্ষিক দিবসের গভীর
অর্থ। প্রতি বছর ১০ই সেপ্টেম্বর,
চীনের সারা দেশ শিক্ষকদের প্রতি
কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই দিনটি পালন করে। এটি কেবল একটি উৎসব নয়, বরং প্রাচীন গুরু-শিষ্য পরম্পরা, শিক্ষার
প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য সমন্বয়ের প্রতীক।
ঐতিহাসিক পটভূমি:
চীনে শিক্ষকদের মর্যাদা প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত।
খ্রিস্টপূর্ব ১১শ শতকে সিজু রাজবংশের সময় থেকেই "শিষ্য তাঁবুর পিতাকে সম্মান
জানায়" (弟子事师, 敬同于父) বলে ধারণা প্রচলিত ছিল। হান ও
তাং রাজবংশে কনফুসিয়াসের জন্মদিন (৮ই সেপ্টেম্বর) রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পালিত হতো, যেখানে সম্রাট স্বয়ং শিক্ষকদের সম্মানিত করতেন ও তাদের প্রতি
কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন । মিং-চিং যুগে এই ঐতিহ্য আরও সুসংগঠিত হয়—শিক্ষকদের
জন্য বিশেষ পুরস্কার ও সরকারি পদ দেওয়া হতো, যা তাদের
সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করত
১৯৩১ সালে চীনা শিক্ষাবিদ তাইশিউ শিয়াও ও চেং ইউপিং
প্রথম আন্দোলন গড়ে তোলেন "৬ই জুন শিক্ষিক দিবস" প্রতিষ্ঠার জন্য, যদিও এটি সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। ১৯৮৫ সালে চীনের জাতীয় পরিষদ
চূড়ান্তভাবে ১০ই সেপ্টেম্বরকে জাতীয় শিক্ষিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকদের অবদানের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা
জাগিয়ে তোলে ।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য:
চীনা সংস্কৃতিতে গুরুকে "দ্বিতীয় পিতা" হিসেবে
বিবেচনা করা হয়। প্রাচীন সময়ে শিষ্যরা গুরুর কাছে যাওয়ার আগে নিয়মিতভাবে
"ছয়টি প্রথা" পালন করতেন:
১. সঠিক পোশাক পরা (正衣冠)
২. হাত ধোয়া (盥洗礼)
৩. গুরুজনকে প্রণাম (叩首礼)
৪. উপহার দেওয়া (মসলা, ফল, মাংস)
৫. চা পরিবেশন
৬. গুরুর নির্দেশনা গ্রহণ ।
এই আচার-অনুষ্ঠান শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা ও গুরুর প্রতি
আনুগত্যের প্রতীক। কনফুসিয়াসের নীতিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই ঐতিহ্য আজও অনেক
প্রতিষ্ঠানে বজায় রয়েছে।
শিক্ষিক দিবসের আধুনিক তাৎপর্য:
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব শুধু আনন্দ উদযাপন নয়, বরং শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির প্রতীক। প্রতিবছর এই দিনে:
শিক্ষকদের পুরস্কারান্নি: জাতীয় ও প্রাদেশিক পর্যায়ে
শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের সম্মানিত করা হয় ।
সাংস্কৃতিক কর্মসূচি: শিক্ষার্থীরা নাটক, কবিতা পাঠ ও শিল্পকর্মের মাধ্যমে শিক্ষকদের অবদান তুলে ধরেন ।
সামাজিক
আন্দোলন: গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে শিক্ষকদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শিক্ষার
প্রসারে ভূমিকা রাখা হয় ।
কবিতা ও উক্তিতে শিক্ষকের মর্যাদা:
চীনা সাহিত্যে শিক্ষকদের গুরুত্ব অপরিসীম। লি বোইয়ুর কবিতায় বলা হয়েছে: "গুরু হলেন আলোর প্রথম কিনারা, যা অন্ধকারকে ভেদ করে জ্ঞানের জগতে প্রবেশের পথ দেখায়।"
অন্যদিকে, ডু ফুয়ানের উক্তি "শিক্ষকের
হাত থেকে শিক্ষা নিলে তা জীবনভর আঁকা থাকে" শিক্ষার স্থায়িত্বকে তুলে
ধরে । এই উক্তিগুলি শিক্ষক-শিষ্য সম্পর্কের গভীরতা ও মানবিক মূল্যবোধকে প্রকাশ
করে।
উপসংহার:
চীনা শিক্ষিক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়: একটি জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি শিক্ষায় নিহিত। যেমন মাও সেতুং বলেছিলেন, "শিক্ষকই সমাজের স্থপতি"। আধুনিক যুগে প্রযুক্তির বিপ্লব, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও জ্ঞানের দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যেও শিক্ষকদের ভূমিকা একটুও কমেনি, বরং তা আরও গভীর ও বহুমুখী হয়েছে। তারা শুধু বইয়ের জ্ঞান শেখানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ও সমাজের প্রয়োজনে অভিযোজনের ক্ষমতা গড়ে তোলার দায়িত্ব বহন করেন।
গ্রামীণ প্রান্তর থেকে শহুরে মেট্রোপলিটন, প্রযুক্তি শিক্ষা কেন্দ্র থেকে শিল্পক্ষেত্র—প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষকরা জ্ঞানের সেতুবন্ধন তৈরি করেন, যা একটি জাতিকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। তাদের নিঃস্বার্থ পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও শিশুদের প্রতি গভীর ভালোবাসা নিয়েই গড়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা।
তাই, শিক্ষিক দিবস কেবল কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন নয়—এটি একটি সতর্কবার্তা ও প্রেরণার দিন: শিক্ষকদের সম্মান, সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে তাদের হাতে শিক্ষার ভবিষ্যত সঁপে দিতে হবে। কারণ, শিক্ষকই সত্যিকার অর্থে "সমাজের স্থপতি" , তাদের হাতেই নির্মিত হয় একটি জাতির জ্ঞান, সংস্কৃতি ও উন্নয়নের ভবিষ্যৎ।
Arif/Raoha
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।