চীনে নারীর নিরাপত্তা কেমন?
শান্তা মারিয়াঃ যে প্রশ্নটি
আমাকে সবসময় শুনতে হয়, সেটি হলো চীন নারীর জন্য কতটুকু নিরাপদ?
আমি চীনের বেশ কিছু শহরে একা থেকেছি। বিভিন্ন শহরে একা ঘুরেছি। তাই
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি এই প্রশ্নটির জবাব দিবো।
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, চীনের নারী-পুরুষ
উভয়েই অত্যন্ত কর্মঠ। চীনের নারীরা সকলেই কোনো না কোনো পেশায় যুক্ত। সকলেই কাজ করে। সেটা
কৃষিতে হোক, ব্যবসায় হোক বা অফিসে। চীনের বর্তমান উন্নয়নের
পিছনে চীনা নারীদের অবদান পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অথচ ১৯৪৯ সালের আগে সামাজিক
রীতিনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীরা ছিল নানা রকম নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর নতুন চীনে নারীদের প্রতি
সকল রকম বৈষম্য বিলোপ করা হয়। আইন ও রাষ্ট্রের চোখে তারা সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সম-অধিকার
পান। রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নীতিতে নারীর সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। চীন বিপ্লবের মহানায়ক
চেয়ারম্যান মাও সে তুং বলেন, চীনের অর্ধেক আকাশ ধরে রেখেছে নারীরা। কথাটি যে কত সত্যি
তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম চীন দেশে বসবাসের সময়।
প্রথম যখন বেইজিং শহরে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের সাংবাদিক
হিসেবে কাজে যোগ দিলাম, তখন দেখেছি এখানে অসংখ্য নারী সংবাদকর্মী পুরুষের পাশাপাশি সমান
দক্ষতা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বিভিন্ন বিভাগে পুরুষের চেয়ে
নারীর সংখ্যাই বেশি। বাংলা বিভাগের পরিচালক একজন নারী। সহকারী পরিচালকও নারী। শুধু
সি আর আই তে নয়, বেইজিং-এ অফিস আদালত, দোকানপাট, রাজপথ যেদিকেই তাকাই না কেন, নারীর ব্যস্ত পদচারণা
চোখে পড়ে সর্বত্র। অসংখ্য নারী যেমন ডেস্কে বসে কাজ করছেন, তেমনি দৈহিক শ্রম-নির্ভর কাজগুলোও করে চলেছেন যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে। কলে-কারখানায়
পুরুষের সমান সংখ্যক নারী শ্রম দিচ্ছেন, উৎপাদনে সমৃদ্ধ করছেন
দেশকে। কৃষি ক্ষেত্রেও নারীরা ফলাচ্ছেন সোনালি ফসল। আমার সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে
পারলাম চীনের অর্থনীতিতে নারীর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের জিডিপির ৪১ শতাংশ
নারীর অবদান। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারীরা চীনের অর্থনীতিকে বেগবান করেছেন। চীনে শিল্প
কারখানার উন্নয়নের পিছনে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা
নারীরা। বলতে গেলে দেশটিকে নারীরা তাদের শ্রমে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নারীর প্রতি সরকারি
সুযোগ সুবিধাও এখানে প্রচুর। মাতৃত্বকালীন ছুটি ৮ মাস থেকে ১ বছর। এই সময়ে নারীরা সবেতন
এবং পদোন্নতিসহ ছুটি পান। শিশুদের জন্য রয়েছে দিবাযত্ন কেন্দ্র। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে
কর্মরত নারীরা দিবাযত্ন কেন্দ্রের সুবিধা পান। নারী-পুরুষের মজুরিতে কোনো বৈষম্য নেই।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তো বটেই, পাশ্চাত্যের অনেক বড় শহরেও পথে-ঘাটে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয় নারীকে।
ইভটিজিং বা নারীর প্রতি অশোভন আচরণ ও যৌন হয়রানি এশিয়া আফ্রিকার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের
অনেক দেশে অনেক নামজাদা শহরের সাধারণ ঘটনা। অথচ এদিক থেকে বেইজিংয়ের নারীরা অত্যন্ত
নিরাপদ। নারীর প্রতি অশোভন আচরণ করার কথা এখানে
কল্পনাও করা যায় না।
চীনে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা কখনও কখনও অপরাধের ভয়বহতা
বিবেচনায় ২০ বছরের জেল হতে পারে। দ্রুত বিচারের আওতায় বিচার করা হয়। তাই বছরের পর বছর
এখানে মামলা ঝুলে থাকে না। সন্দেহাতীতভাবে এবং ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ধর্ষণ প্রমাণিত
হলে অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড বা
২০ বছরের জেল হয় এবং তা দ্রুত কার্যকর হয়। যৌন হয়রানির জন্য বিভিন্ন মেয়াদে বেশ কঠিন
শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তারমধ্যে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে ৭ থেকে ২০ বছরের জেলও হতে
পারে। আর কোনো শিক্ষার্থী যদি যৌন হয়রানি করে তাহলে তার শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যায়, এটা
বলা চলে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কেউ অন্যকে যৌন হয়রানি করে তাহলে তার ক্যারিয়ার শেষ।
চীনের গ্রাম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতাও আমার রয়েছে। গ্রাম সরকারেও নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য
নেই। বৈষম্য নেই ক্ষমতার ক্ষেত্রেও। গ্রামেও নারীরা নিরাপদ, শহরের মতোই। চীনে তাই ধর্ষণ শোনাই যায় না। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার
জন্য এখানে রাষ্ট্রের তিনটি শাখাই আন্তরিক এবং কঠোর।
২০১১-১২ সালে আমি ছিলাম চীনের রাজধানী বেইজিং-এ।
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।