চাইনিজ ভদ্রতা: নীরব সম্মান আর সুপ্ত সংকেতের জগতে এক সফর
আপনি প্রথমবারের মতো চীনে এসেছেন। সবার কাছেই শুনেছেন চীনা নাগরিকরা খুবই বন্ধুসুলভ। আপনিও বেশ বন্ধুসুলভ একজন মানুষ। দেশে আপনার বন্ধুত্বের প্রশংসা সবার মুখে। চীনে আসার বেশ কিছুদিন ইতিমধ্যে পার হয়ে গেছে, কিন্তু আপনি কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছেন না সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে। সম্পর্ক বেশ ভালোই গড়ে তুলছেন আপনি, কিন্তু কিছুদিন পর কেউ আর আপনার সাথে যোগাযোগ রাখছে না বা আপনার ওপর আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কিন্তু সমস্যাটা আসলে কোথায়? কেউ আপনাকে কিছু বলছেনও না। চলুন আরও দুই-একটা কথা বলি আপনাকে।
ধরুন, এক বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। আনন্দের বশে সঙ্গে করে একটা বিলাসবহুল ঘড়ি নিয়ে গেলেন উপহার হিসেবে। দরজার সামনে আপনার বন্ধুটি থমকে গেল, তার মুখে হালকা এক হাসি—কিন্তু চোখ বলছিল অন্য কথা। পরে জানতে পারলেন, ঘড়ি চীনে মৃত্যুর প্রতীক!
চাইনিজ এটিকেট মানে শুধু “ধন্যবাদ” বলা নয়, বরং প্রতিটি ছোট কাজের মধ্যে ভদ্রতা, আত্মসম্মান ও সম্মানের ছায়া থাকে। চলুন, চাইনিজ সামাজিক ভদ্রতা বা etiquette-এর এই জটিল, কিন্তু মায়াবী জগতে একটু ডুব দেই।
উপহার দেওয়ার সময় কী জিনিস এড়িয়ে চলবেন?
চীনে উপহার দেওয়া একটি শিল্প। ভুল উপহার মানে হতে পারে সম্পর্কের শুরুতেই ভুল বার্তা।
নিষিদ্ধ বা এড়িয়ে চলার মতো উপহার:
ঘড়ি (钟 - zhōng): 'ঘড়ি দেওয়া' চীনা ভাষায় “送钟 (sòng zhōng)”, যার উচ্চারণ মৃত্যুতে বিদায় জানানোর মতো শোনায়। এটি মৃত্যুর প্রতীক।
ছাতা (伞 - sǎn): ছাতার চীনা উচ্চারণ “sǎn” মানে বিচ্ছিন্ন হওয়া। এটি সম্পর্কের ফাটল বোঝাতে পারে।
সাদা বা কালো রঙের জিনিস: সাধারণত এই রংগুলো শোক বা মৃত্যুর সাথে জড়িত। উৎসব বা আনন্দের সময় রঙিন বা লাল প্যাকেটই গ্রহণযোগ্য।
নাশপাতি (梨 - lí): “lí” শব্দটি “বিদায়” শব্দের মতো শোনায়। প্রেমিক-প্রেমিকা বা বন্ধুদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে।
চিনামাটির বা কাচের তৈজসপত্র: এগুলো ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে, যা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার প্রতীক ধরা হয়।
বিজোড় সংখ্যার উপহার: উপহার দেওয়ার সময় জোড় সংখ্যা পছন্দ করা হয়। তবে ‘৮’ খুবই সৌভাগ্যের প্রতীক, কারণ এর উচ্চারণ “ba” শুনতে “ধনী হওয়া” (发 - fā) এর মতো।
ভালো উপহার হতে পারে:
চা, স্বাস্থ্যকর খাবার, বিদেশি চকোলেট, বই (বিশেষত যদি সেটা চিন্তাশীল হয়), ছোট কারুশিল্প ইত্যাদি।
টিপস: উপহার কখনও এক হাতে দেবেন না, দুই হাতে দিন। এবং কেউ যদি প্রথমবার না নেয়, অবাক হবেন না—এই ‘না’ বলা আসলে ভদ্রতা।
খাবার টেবিলে ভদ্রতা: আচরণেই আসল শ্রদ্ধা
চীনে খাবার মানে শুধু ক্ষুধা মেটানো নয়, এটা সামাজিক বন্ধনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এখানে খাবার টেবিলের শিষ্টাচার ঠিকঠাক না মানলে কিন্তু চুপচাপ কেউ কিছু বলবে না—কিন্তু আপনি ধীরে ধীরে ‘ভদ্র অতিথি’ তালিকা থেকে ছিটকে পড়বেন।
চপস্টিক ব্যবহারের কিছু মূল নিয়ম:
খাবারে খোঁচা দেবেন না। এটা অশোভন এবং শিশুসুলভ আচরণ ধরা হয়।
চপস্টিক খাবারে সোজা করে বসিয়ে রাখবেন না, বিশেষ করে ভাতে। এটি মৃতদের জন্য ধূপ জ্বালানোর প্রতীক।
চপস্টিক দিয়ে অন্য কাউকে খাবার দেবেন না। খাবার কাউকে দিতে হলে প্লেট ব্যবহার করুন।
খাবার টেবিলে কিছু বাড়তি ভদ্রতা:
বয়োজ্যেষ্ঠ আগে খাবেন: বড়দের আগে খাওয়া শুরু করাটা অভদ্রতা।
নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলুন: অন্যের থালা বা কমন প্লেট থেকে সোজা মুখে খাবার নেওয়া উচিত নয়।
সব খাবার শেষ করবেন না: এটা লোভী মনে হতে পারে। শেষ খাবারটা রেখে দিলে বোঝায়, আপনি ভদ্রভাবে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন।
চুপচাপ খাবার শুরু করবেন না: আগে বলবেন “开动了 (kāi dòng le)” – অর্থাৎ, "আমি খাচ্ছি", যেন অন্যরাও শুরু করতে পারেন।
সামাজিক কথাবার্তায় সংযম এবং সংকেত
কেউ যদি খুব নরমভাবে বলে: “Let me think about it” — সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবে 'না' বোঝায়। চীনারা সরাসরি “না” বলতে চায় না, কারণ এটি অন্যকে অপমান করার মতো শোনাতে পারে।
তর্ক বা বিতর্ক জনসমক্ষে এড়িয়ে চলা উচিত। এটা সম্মানহানির শামিল। চীনা সমাজে "মুখ রক্ষা" (face-saving) বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কাউকে উপদেশ দিতে চাইলে সেটা ব্যক্তিগতভাবে এবং সম্মান রেখে বলতে হবে।
লাল খাম এবং অর্থের সৌজন্য
বিশেষ উৎসবে (যেমন চাইনিজ নিউ ইয়ার, বিয়ে, জন্মদিনে) লাল খাম (红包 - hóng bāo) এর মাধ্যমে অর্থ উপহার দেওয়া যায়। এই খামে রাখা অর্থের অংকেও ভদ্রতার ছাপ থাকে।
৪ (四 - sì) মানে "মৃত্যু"র মতো শোনায়, তাই এটি এড়িয়ে চলা উচিত।
৮ (八 - bā) মানে সৌভাগ্য ও সম্পদ।
৬৬, ৮৮ বা ১৬৮-এর মতো সংখ্যাগুলো খুবই শুভ ও জনপ্রিয়।
শেষ কথা: আপনি অতিথি, কিন্তু সেই সাথে আপনি আপনার সংস্কৃতির এক নীরব বার্তাবাহকও। চীনে একজন অতিথিকে সম্মানের চোখে দেখা হয়, কিন্তু সেই অতিথিকেও নিজেকে সম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করতে হয়। আপনি শুধু যাত্রা করছেন না, বরং একটি সাংস্কৃতিক সেতু পার হচ্ছেন।
চপস্টিকটা একটু সোজা ধরুন, উপহারটা দু’হাতে দিন, আর কেউ “না” না বললেও না বললে, সেটা শুনতে শিখুন। এটাই চাইনিজ এটিকেট—নীরব ভাষার মতো এক জগৎ, যেখানে আচরণই আসল বার্তা।
আপনি জানেন কি?
চীনে কেউ যদি হাঁচি দেয়, সাধারণত কেউ “Bless you” বা কিছুই বলেন না। কারণ তারা মনে করে, হাঁচি দেওয়া পুরোপুরি প্রাকৃতিক—তা নিয়ে মন্তব্য করা অপ্রয়োজনীয়!
Arif
BCYSA.ORG এর নিউজ-এ আপনিও লিখতে পারেন। গণচীনে প্রবাস জীবনে আপনার অভিজ্ঞতা, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খবরাখবর, আনন্দ-বেদনার গল্প, স্মৃতিচারণ, ভ্রমণ, অনুভূতি, বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর ছবিসহ আমাদের (বাংলা অথবা ইংরেজিতে) পাঠাতে পারেন। লেখা পাঠানোর ইমেইল : news.bcysa@outlook.com।